একের পর এক কঙ্কালে বিস্মিত গবেষকরা

প্রত্নতাত্ত্'বিক গবেষণার ফলে প্রাচীনকালের অনেক কিছু সম্পর্কেই মানুষ জানতে পারে। প্রাচীনকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি প্রায় সবকিছু সম্পর্কেই অনেকটা স্বচ্ছ ধারণা দেয় এসব গবেষণা। প্রত্নতাত্ত্'বিক অনুসন্ধান থেকে প্রা'প্ত তথ্য অনেক সময় কৌতূহলী মানুষের পাশাপাশি গবেষকদেরও বিস্মিত করে। তেমনই একটি অনুসন্ধান নিয়ে এই লেখা।

যু'দ্ধের জন্য মানুষের সক্ষ'মতা ও এটি মানব প্রকৃতির একটি অনিবার্য অংশ কিনা তা নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, দর্শন ই'ত্যাদি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বেশ আলোচিত বি'ষয়। প্রাচীন কাল থেকে মানুষ কেন যু'দ্ধে লি'প্ত হয়? কিংবা আন্ত-গোষ্ঠী সহিং'সতার জন্য মূল কারণগু'লো কী কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আসে- শি'কার ও কৃষি থেকে সংগ্রহ, অ'স্ত্রের 'বিকাশ, পরিবেশগত সীমাব'দ্ধতা বা জনসংখ্যা বৃ'দ্ধির ফলে সৃ'ষ্ট বিভিন্ন সংকটের মতো কারণগু'লো।

এর মধ্যে, জনসংখ্যার চাপের অনুমানটি সম্প্রতি আরো প্রগাঢ় হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিভিন্ন সংকট দেখে। ইতিপূর্বের অনেক হাইপোথিসিসে বলা হয়েছে যে জনসংখ্যা বৃ'দ্ধির ফলে সম্পদের ঘাটতি 'হতে পারে, যার ফলে প্রতিযোগিতা এবং সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যদিও এই দাবির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তারপরও খুব কম গবেষণা আছে যা প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্'বিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার চাপের কারণে আন্ত-গোষ্ঠী সহিং'সতার উৎপত্তিকে যৌ'ক্তিকভাবে সমর'্থন করে।

এই ফাঁ'কটি দূর করার জন্য, ওকায়ামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাওকো মাতসুমোতোর নেতৃত্বে সম্প্রতি জাপানের কিউশু দ্বীপে একদল গবেষক একটি প্রত্নতাত্ত্'বিক অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তারা জাপানের মধ্য ইয়াওই যুগের (৩৫০ খ্রি'ষ্টপূর্ব -২৫ খ্রি'ষ্টাব্দ) একটি সাইট খনন করেন। সেখান থেকে আবি'ষ্কৃত মানব কঙ্কালের উপর তারা গবেষণা করে জানতে পেরেছেন জনসংখ্যা বৃ'দ্ধির ফলে যু'দ্ধ এবং অন্যান্য সহিং'সতা চরম মাত্রায় বৃ'দ্ধি পায় সেখানে। এর ফলে অ'সংখ্য মানুষ নৃ'শংসভাবে হ'ত্যার শি'কার হয়। জনসংখ্যা বৃ'দ্ধির ফলে সৃ'ষ্ট নানাবিধ সংকটে এমন হ'ত্যাকাণ্ড সং'ঘটিত 'হতে পারে বলে ধারণা করেছেন গবেষকরা। প্রত্নতাত্ত্'বিক সাইট থেকে প্রা'প্ত এসব সারি সারি কঙ্কাল ও গবেষণার ফলাফল প্রত্নতত্ত্ববিদদেরও বিস্মিত করেছিল।

জার্নাল অব আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্সে সম্প্রতি প্রকাশিত সংখ্যায় এমন তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে। যেখানে গবেষকরা দাবি করেছেন, জনসংখ্যার চাপে কিউশু দ্বীপে মধ্য ইয়াওই যুগে (৩৫০ খ্রি'ষ্টপূর্ব -২৫ খ্রি'ষ্টাব্দ) সম্পদ ও ভূমির ঘাটতি সৃ'ষ্টি হয়। এরই ফলস্বরূপ সহিং'সতা বৃ'দ্ধি ও নৃ'শংস হ'ত্যাকাণ্ডের ঘটনা বৃ'দ্ধি পায় সেখানে।

গবেষকরা জাপানের কিউশু দ্বীপে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্'বিক সাইটে খনন থেকে সংগৃহীত মানব কঙ্কালের অবশি'ষ্টাংশ ও জারের কফিনগু'লোর উপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এসব কঙ্কাল ও জারের কফিনগু'লো খ্রি'ষ্টপূর্ব ৩৫০ থেকে ২৫ খ্রি'ষ্টাব্দের মধ্যেকার ছিল।

Interesting For You

গবেষণার জন্য এই স্থান নির্বাচন করা হয় দুটি কারণে। প্রথমত, অতীতের গবেষণায় জানা গেছে যে, ইয়াওই যুগে কিউশু দ্বীপে (কিউশু জাপানের তৃতীয় বৃ'হত্তম দ্বীপ এবং জাপানের চারটি দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত) সহিং'সতা বৃ'দ্ধি পেয়েছিল, যা পূর্ববর্তী ৩৫০ খ্রি'ষ্টপূর্বাব্দে শেষ হওয়া জোমোন যুগের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। জোমোন যুগ হলো প্রাগৈতিহাসিক জাপানের আনুমানিক ১২ হাজার খ্রি'ষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৫০ খ্রি'ষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী সময়কাল। আর স্থান নির্বাচনের দ্বিতীয়ত কারণটি হলো- মূল ইয়াওই জনগণ ছিল কৃষক, যারা কোরিয়ান উপদ্বীপ থেকে কিউশুতে এসেছিল। এরপর তারা দেশীয় জোমোন শি'কারি-সংগ্রাহকদের পাশাপাশি বসবাস করতে থাকে। এর ফলে কিউশু দ্বীপে জনসংখ্যার ঘনত্ব দ্রুত বৃ'দ্ধি পায়।

অতীতের খননকাজে কিউশুর উত্তরাঞ্চলের ছয়টি পৃথক ক্ষুদ্র অঞ্চল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মধ্য ইয়াওই সময়ের সমাধিস্থলের সন্ধান পায় গবেষকরা। এই এলাকাগু'লোকে ইতোশিমা সমভূমি, সাওয়ারা সমভূমি, ফুকুওকা সমভূমি, মিকুনি পাহাড়, পূর্ব সুসুকুশি সমভূমি এবং কেন্দ্রীয় সুসুকুশি সমভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রতিটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে, জাপানি গবেষকরা সম্ভাব্য জনসংখ্যার আকার অনুমান করার জন্য উ'দ্ধারকৃত সমাধির জারের সংখ্যা ব্যবহার করেছিলেন। তারা ধরেই নিয়েছিলেন অধিক সংখ্যক সমাধি জারগু'লো বেশি লোকের বসবাসের প্রমাণ। আবাদযোগ্য জমির প্রাপ্যতার সঙ্গে জনসংখ্যার আকারের তুলনা করে জনসংখ্যার চাপ পরিমাপ করা হয়। জনপ্রতি কম কৃষিজমিকে উচ্চ জনসংখ্যার চাপ হিসেবে ধ’রা হয়।

মধ্য ইয়াওই থেকে প্রা'প্ত বিভিন্ন কঙ্কালের অবশি'ষ্টাংশ সেই সময়ে সহিং'সতার একটি স্প'ষ্ট বৃ'দ্ধি প্রমাণ করেছে। অধিকাংশ কঙ্কালে আঘা'তের চিহ্ন পেয়েছেন জাপানি বিজ্ঞানীরা। তাদের উন্মোচিত তথ্য জনসংখ্যা বৃ'দ্ধি ও সহিং'সতার মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক প্রকাশ করেছে। উচ্চ জনসংখ্যার চাপযুক্ত অঞ্চলে সহিং'সতার মাত্রা বেশি ছিল বলে দেখা গেছে। কারণ এসব অঞ্চলে প্রা'প্ত মানব কঙ্কালগু'লোতে মা'রাত্মক আঘা'তের চিহ্ন ছিল।

এছাড়া কিউশু দ্বীপে মধ্য ইয়াওই যুগের এসব সমাধিস্থলে শাসকগোষ্ঠীর কিছু সদস্যের সমাধিরও সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। রাজকীয় সমাধিতে অ'স্ত্র ও আয়নাসহ অন্যান্য সামগ্রীও পাওয়া গিয়েছে। রাজকীয় সমাধিযুক্ত উপ-অঞ্চলে সহিং'সতার মাত্রা কম ছিল বলে গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে সহিং'সতার মাত্রা দমনে শক্তিশালী অ'ভিজাতদের ভূমিকা ছিল।

তবে শুধু জনসংখ্যার চাপের কারণেই সহিং'সতার মাত্রা বেশি হওয়ার এই যুক্তি সবক্ষেত্রে সঠিক নয়। সহিং'সতা বৃ'দ্ধির এটি হয়তো একটি কারণ ছিল তবে একমাত্র কারণ নয়।

গবেষকদের একটি অংশ মনে করে, শি'কারি-সংগ্রাহক থেকে কৃষি সমাজে রূপান্তর গোষ্ঠীর মধ্যে এবং তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃ'ষ্টি করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত আরো সহিং'সতা এবং যু'দ্ধের দিকে পরিচালিত করেছিল। অন্যরা মনে করেন যে, নতুন ও মা'রাত্মক অ'স্ত্রের 'বিকাশ, নতুন এলাকায় তাদের উপস্থিতি সহিং'সতা বৃ'দ্ধির অন্যতম কারণ ছিল। এই দুইটি তত্ত্বই ২ হাজার বছর আগের কিউশু দ্বীপের পরিস্থিতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন অধ্যাপক মাতসুমোতো।